জহিরুল ইসলাম খান ও বেলাল রিজভী: মাদারীপুরে চরমপন্থীদের হাতে খুনের ঘটনায় এজাহারভূক্ত প্রধান ২ আসামীসহ ৫ আসামীর নাম বাদ দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দিয়েছে শিবচর পুলিশ।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে এই আসামীদের বাদ দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তৎকালীন ওসি একেএম মাসুদ খান। এদিকে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মীমাংসার জন্য বাদী পক্ষকে চাপ প্রয়োগ করেছেন শিবচর থানার এএসআই নিউটন দত্ত।
‘১২ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলা থেকে নিস্কৃতি পেয়েছি’-চরমপন্থি অধ্যুষিত এলাকাতে আসামীদের এই ধরণের প্রচারে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।
গতকাল বাদী পক্ষের দেয়া অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ঠ একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৪ আগস্ট রাতে চরমপন্থী অধ্যুষিত মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার নিলখী ইউনিয়নের চরকামারকান্দি গ্রামের গ্রাম-পুলিশ হাবিবুর রহমানকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে নির্জন ক্ষেতের মধ্যে গলাকেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পরের দিন নিহতের স্ত্রী গোলেনুর বেগম বাদী হয়ে ১১ জনের নাম উল্লেখ ও আরো অজ্ঞাত ১০ জনের নামে শিবচর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় আব্দুল ওহাব মাতুব্বর (৫৫) ও মোঃ দেলোয়ার মাতুব্বরকে (৩৪) প্রধান আসামি করা হয়।
নিহত হাবিবুরের লাশ উদ্ধারের সময় পুলিশ একটি টর্চলাইট, এক জোড়া স্যান্ডেল ও খুনীদের একজনের শার্টের পকেটের অংশ উদ্ধার করেছিল। এই মামলায় গত বছর ২৬ আগস্ট এজাহারভূক্ত আসামীদের মোবাইল কললিস্টের সুত্র ধরে ওয়াসিম মোড়ল নামে একজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরে ওয়াসিম আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়।
আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে ওয়াসিম জানায়, ‘আমি হাবি চৌকিদারের পা চেপে ধরি। সাইদুল নিজ হাতে হাবি চৌকিদারের গলায় ছুরি চালায়। এরপর মৃত্যু নিশ্চিত করতে পলাশ আবার ছুরি চালায়।’
আলোচিত হাবি চৌকিদার হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা এভাবেই জবানবন্দি দিলেও মামলার মূল আসামী ওহাব মাতুব্বর, দেলোয়ার মাতুব্বরসহ পাঁচজনকে বাদ দিয়ে চার্জশীট দেয় পুলিশ। মামলার চার্জশীট থেকে রেহাই পেয়ে মামলার বাদী পক্ষকে মিথ্যা মামলা দিয়ে ফাঁসানো ও হত্যার হুমকি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নিহত হাবিবুর রহমান ওরফে হাবি চৌকিদারের মেয়ে মেরিনা আক্তার বলেন, আমার বাবাকে খুনের প্রায় ৩ মাস আগে ওই এলাকায় ৫টি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এতে জড়িতরা সন্দেহ করে আমার বাবাই খবর দিয়ে র্যাব-পুলিশকে দিয়ে ওই ৫ জনকে ধরিয়ে দিয়েছে। এতে তারা আমার বাবার উপর ক্ষিপ্ত ছিল। তারাই আমার বাবাকে খুন করে। ১৪ আগষ্ট সন্ধ্যায় ওহাব মাতুব্বরের ছেলে দেলোয়ার জরুরী মিটিং আছে বলে আমার বাবা হাবি চৌকিদারকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায়। এ সময় বাড়ির পাশে রাস্তায় ওহাব মাতুব্বর, রব, সাবু, মেরাজ সাহাবদ্দিনসহ ১২ থেকে ১৫ জন লোক ছিল। দীর্ঘ সময় পরে বাড়ি না ফেরায় রাত ৮টার দিকে আমার বাবার মোবাইলে ফোন দিয়ে দেখি তার মোবাইল বন্ধ। পরে আমরা রাতে বিভিন্ন স্থানে খোজাখুজি করেও তাকে পাইনি। পরের দিন খুব ভোরে বাবার গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়।
হাবি চৌকিদারের মেয়ে মেরিনা আক্তার আরো বলেন, এই ঘটনায় এজাহারভূক্ত কোন আসামী গ্রেপ্তার হয়নি। কয়েক দিন আগে শুনি মামলার প্রথম পাঁচ আসামীর নাম বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশীট দেয়া হয়েছে। তখন বিষয়টি জানতে আমরা শিবচর থানার ওসি মাসুদ স্যারের কাছে ফোন করলে তিনি বলেন, ‘মামলা করে তোমরা ওদের সাথে পারবা, তার চেয়ে ভালো তোমাদের দেড় লাখ টাকা দিবে, তা নিয়ে মীমাংসা হয়ে যাও। এছাড়া মামলা তুলে নিতে শিবচর থানার এএসআই নিউটন দত্ত একাধিকবার আমাদের হুমকি দিয়েছে।’
মামলার বাদী গোলেনুর বেগম বলেন, ‘আমার স্বামীকে খুন করার সময় তিনি নিজেকে বাঁচাতে ধাক্কাধাক্কি করেন। এ সময় হত্যাকারীদের একজনের জামার পকেট টেনে ছিড়ে ফেলেন আমার স্বামী। আমার স্বামীর লাশ উদ্ধারের সময় তার হাতের মুঠোর মধ্যে ওই জামার পকেটের অংশ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। আগের দিন সন্ধ্যায় ডেকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওই জামা পড়নে ছিল মামলার আসামী দেলোয়ার। আমরা তাকে ২নং আসামী করেছি। কিন্তুসেই দেলোয়ারকে চার্জশীট বাদ দিয়েছে পুলিশ। আমরা গরীব মানুষ, ঠিকমত খেতে পারি না, কিভাবে পুলিশকে টাকা দেব। পুলিশকে টাকা দিতে না পারার কারণেই আমাদের মামলার এই অবস্থা করেছে।’
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী জানান, ‘হাবি হত্যা মামলার প্রধান আসামী ওহাব মাতুব্বর বিভিন্ন সময় বাজারের চায়ের দোকানে বলে বেড়াচ্ছেন একজন খুন করে ১২ লাখ টাকায় মামলা থেকে ছাড়া পেয়েছি। এ রকম দু’একটা খুন করলে আমাদের কিছুই হবে না।’ এতে এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা শিবচর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আবুল খায়েরকে রহস্যজনক কারণে মামলার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। এরপরে তদন্তভার নেন তৎকালীন শিবচর থানা ওসি একেএম মাসুদ খান।
মামালার বাদীপক্ষের অভিযোগ, ওসি মাসুদ খান ১২ লাখ টাকার বিনিময়ে মামলার এজাহারভূক্ত প্রধান ৫ আসামীর নাম বাদ দিয়েছেন।
বিশ্বস্ত একটি সূত্রে জানা গেছে, শিবচর থানার এএসআই নিউটন দত্তের বাসায় ১২ লাখ টাকা লেন-দেন হয়েছে। যা তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে বলে দাবী সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
নিহতের মেয়ে মেরিনা আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘শিবচর থানার ওসি মাসুদ খান দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মামলা নিস্পত্তি করার জন্য আমাদের উপর চাপ প্রয়োগ করেছিল। এ বিষয় নিয়ে এএসআই নিউটন দত্ত আমাদের বাড়ি আসে এবং মোবাইলে অনেক চাপ দিতে থাকেন। তিনিও টাকা বিনিময়ে আসামীদের সাথে মীমাংসা করে দিতে চেয়েছিলেন। এতে রাজি না হওয়ায় আমাদেরকে ভয় দেখানো হয়েছে। টাকার বিনিময়ে চার্জশিট থেকে অব্যাহতি নিয়ে আসামীরা প্রকাশ্যে আমাদের পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিচ্ছে। পুলিশকে জানালে পুলিশ তাদের পক্ষেই কথা বলে।’
সম্প্রতি একেএম মাসুদ খান শিবচর থানা থেকে অন্যত্র বদলী হয়েছেন। এদিকে অভিযোগের বিষয়ে শিবচর থানার এএসআই নিউটন দত্তের সাথে একাধিক বার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।